মানু’র চোখে জল
–সুজিত চট্টোপাধ্যায়
রাত প্রায় বারোটা।
এইমাত্র শবদেহ দাহ করে ফিরলো মানু। কথাটা মা’কেও জানালো না। মা জানলে এই শীতের রাতে তাকে স্নান না করিয়ে ছাড়বে না। মাথা খারাপ, জেনেশুনে সেই ভুল কেউ করে ?
অবিশ্যি এমন ঘটনা মানুর এই বাইশ বছরের জীবনে প্রথম ঘটলো এমন নয়। এটা যেন ওর নেশার মতো। খবর পেলেই ছুট। কত যে শবদাহ কাজে অংশ নিয়েছে মানু সে হিসেব কে-ই বা রাখে। ওর শুধু মনে হতো চলে যাওয়া মানুষটার শেষ যাত্রায় যাত্রী হয়ে তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা যায়। স্বজন হারা শোকার্ত পরিবারের পাশে সহমর্মিতা নিয়ে পাশে থাকা যায়। ভালো লাগে। নিজের অন্তরের পবিত্রতার পরশ পাওয়া যায়।
মানু র বাবা বলতেন,,,
আমার চার ছেলে। আমি মারা গেলে চার ছেলের কাঁধে চড়ে যাবো।
সময় বড়ো দ্রুত পাল্টে যায়। পাল্টে যায় ব্যবহারিক গতানুগতিক ধারার জীবনের গতি।
কালের নিয়মে একদিন মানু মানে বর্তমানের মৃন্ময় মুখার্জি যিনি একটি বিখ্যাত কর্পোরেট হাউসের সি ই ও,, তার বাবা একাশি বছর বয়সে দেহ রাখলেন।
এখন কেউ কাঁধে চড়ে যায় না। শেষ গন্তব্যের জন্য বিশেষ যানের ব্যবস্থা আছে। একেবারে সাজানো গোছানো মানে না ফেরার দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে যেমনটি সাজগোজের নিয়মমাফিক প্রয়োজন তার সুচারু বন্দোবস্তো করাই আছে শুধু দাম ধরে দিলেই হবে।
নাহঃ,, বর্তমানের অন্তিম যাত্রায় খাট লাগেনা। কাঁধে গামছার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। হাতে অগুরু সুগন্ধির যুগ আর নেই।
হরিধ্বনি তে ও গুরুগম্ভীর ভাব। সেই উচ্চস্বরের চঞ্চলতা কোথায় হারিয়ে গেছে। মৃতের পায়ের তলায় আলতা লাগিয়ে সাদা ফুলস্কেপ কাগজে ছাপ তুলে রাখার কথা কারোর মনেই আসেনা আর। বুক চাপড়ে কেঁদে দাঁতে দাঁত চেপে ফিট্ হয়ে যাবার দিন শেষ। এখন গম্ভীর মুখে ফিসফিস করে কথা আর হালকা করে নাকের সর্দি টানার মতো আওয়াজ করেই শোক প্রকাশ করা রেওয়াজ।
এক্ষেত্রে ঠিক তেমনই হয়ে চলেছে।
” যেতে তো একদিন সকলকেই হবে, দু’দিন আগে কিংবা পরে। ”
এহেন দার্শনিক ধারার কথাবার্তা গুনগুন করে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
রাত প্রায় বারোটা ।
মৃন্ময় মুখার্জি ( মানু ) একা ছাদে আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলো,,
” বাবা, তোমার ইচ্ছে পূরণ করতে পারলাম না। সময় পাল্টে গেছে বাবা। এখন সবাই বড্ড একা।
যাবার কালে তো অবশ্যই ।
ক্ষমা করে দাও বাবা,, ক্ষমা করে দাও,,,। ”
না না,, মৃন্ময় মুখার্জি নয় ,
মানু র চোখে জল ,, পরিতাপের।।